বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ। তাড়াহুড়া করলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। একদিকে যেমন পড়াশোনার প্রস্তুতির প্রয়োজন, অন্যদিকে কাগজপত্র ও প্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ও কম গুরুত্বপূর্ণ নায়। যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্ট প্রোগ্রামে পূর্ণ অর্থায়নে পড়ার সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ। তিনি জানান, একেক দেশের বৃত্তির প্রক্রিয়া একেক ধরনের। আবার বিষয়ভিত্তিক ভর্তির প্রক্রিয়াও ভিন্ন। আগে থেকে শিক্ষার্থীরা যদি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন, তাহলে বৃত্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সহজে আয়ত্ত করতে পারবেন।
প্রথম ধাপ—প্রস্তুতি
শুরুতে একটি বছরভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া ভালো। ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আলোচিত বৃত্তি ইরাসমাস মুন্ডাস। এই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী অনুপমা নিলয়া বর্তমানে স্প্যানিশ রিসার্চ কাউন্সিলে গবেষক হিসেবে কর্মরত। তিনি মনে করেন, শুরুতেই একেকটি কাজের জন্য ‘টাইমলাইন’ ঠিক করে ফেলা উচিত।
দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা: ভাষাসংশ্লিষ্ট দক্ষতার ক্ষেত্রে আইইএলটিএস (ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম) বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত।
অনুপমা বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক ও সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর জন্য ৭.০ বা ৭.৫ আইইএলটিএস স্কোর গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বৃত্তিগুলোতে ৬.৫ স্কোরও গ্রহণ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে টোয়েফল (টেস্ট অব ইংলিশ অ্যাজ আ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ) স্কোর লাগে। অতএব প্রয়োজন বুঝে ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা দেওয়া উচিত। জার্মানি, ফরাসি, চীনা— নানা ভাষাই আপনি শিখতে পারেন। সেই ভাষাসংশ্লিষ্ট বৃত্তি পাওয়া তাহলে সহজ হবে।
যাঁরা ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়বেন, জিম্যাট (গ্র্যাজুয়েট ম্যানেজমেন্ট অ্যাডমিশন টেস্ট) তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে চাইলে জিআরই (গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশনস) স্কোর দরকার। তবে অনুপমা নিলয়া জানান, ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তির জন্য জিআরই-জিম্যাট স্কোর প্রয়োজন হয় না।
অধিকাংশ বৃত্তির ক্ষেত্রে নেতৃত্বের গুণাবলি, স্বেচ্ছাসেবক বা গবেষক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা, এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই এসব অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে আগে থেকেই।
সনদ, সুপারিশপত্র, পাসপোর্ট: শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, নম্বরপত্র ইত্যাদি জোগাড় করে ফেলতে হবে। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সনদ তুলতে গেলেও একধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়। তাই শেষ মুহূর্তের জন্য ফেলে না রেখে সনদ সংগ্রহ করুন যত দ্রুত সম্ভব। হালনাগাদ পাসপোর্টও হাতে রাখুন।
ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্ত খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি) ও লেটার অব রিকমেন্ডেশন (এলওআর) বৃত্তির জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই একটি সাধারণ মানের এসওপি ও শিক্ষকের কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে বৃত্তির জন্য জমা দেন। যেহেতু সব বৃত্তিই প্রতিযোগিতামূলক, তাই এসব হেলাফেলার জন্যও অনেকে বাদ পড়ে যান। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নিজের স্টেটমেন্ট অব পারপাস নিজেকেই লিখতে হবে। আপনি যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছেন, সেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিন। অনেক সময় ভাষা দক্ষতা বা জিআরই-জিম্যাটের স্কোর কম হলে ভালো সুপারিশপত্রই আপনাকে এগিয়ে রাখবে।’
দ্বিতীয় ধাপ—বৃত্তির খোঁজ ও আবেদন
দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আবেদনপ্রক্রিয়া ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড বৃত্তি নিয়ে দ্য অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে পড়েছেন মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তো বৃত্তির খোঁজ পাওয়াই যায়। এ ছাড়া সরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের কাছ থেকে ই-মেইল করেও তথ্য জানতে পারেন।
বৃত্তির সন্ধান: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কার্যকর। হালনাগাদ সরকারি বৃত্তির তথ্য পাওয়া যায় সব সময়। বিভিন্ন দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজেও বৃত্তির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া চোখ রাখতে পারেন পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে।
কানাডার লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল গবেষক রামিম তানভীর রহমান বলেন, ‘আপনি যে বিষয়ে পড়তে বা গবেষণা করতে চান, সে বিষয়ের অধ্যাপকদের কাজের দিকে নজর রাখতে হবে। কোন অধ্যাপক কী নিয়ে গবেষণা করছেন, কেমন অনুদান পাচ্ছেন, এসব জানা থাকলে আবেদন করা সহজ হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় সন্ধান: কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে আপনি পড়তে চান? কেন এই বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়টি বেছে নিলেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনার জানা থাকা চাই। চিভনিং বৃত্তিপ্রাপ্ত শাহরিয়ার রহমান বলেন, চিভনিংসহ অনেক বৃত্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার জমা দিতে হয়। ভারতের আইসিসিআর বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী নাহরিন রাত্রী জানান, সে দেশে বৃত্তিসহ পড়তে চাইলে আবেদনের সময় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ের নাম সংযুক্ত করতে হয়। পরে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হলে যোগ্যতা অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পান।
তৃতীয় ধাপ—সাক্ষাৎকার
বৃত্তির সর্বশেষ ধাপে শিক্ষার্থীকে অনেক সময় সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হয়। অনলাইনে মৌখিক সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসও সাক্ষাৎকার নিতে পারে। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দূতাবাসের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশের সরকারি বৃত্তির জন্য শিক্ষার্থীদের দূতাবাসের মাধ্যমে সাধারণ জ্ঞাননির্ভর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে হয়।
আরও যা মাথায় রাখতে হবে
অর্থের জোগান: জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্লকড অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বৃত্তির জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে স্টুডেন্ট ফাইল চালু করতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্টুডেন্ট ফাইল চালুর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সংকটের মুখে পড়ছেন। অনেক ব্যাংক স্টুডেন্ট ফাইল খোলার সুযোগ বন্ধ রেখেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিস্থিতি জানিয়ে ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
আবেদনের সময়: বৃত্তির ডেডলাইনের নির্দিষ্ট সময়ের আগে আবেদন করতে হবে। চিভনিং বৃত্তিসহ বিভিন্ন বৃত্তির অনলাইনে আবেদনের শেষ দিকে অনেক আবেদন জমা পড়ে বলে নানা জটিলতায় অনেকেই আবেদন জমা দিতে পারেন না। আবার শেষের সময় অনেক আবেদনের চাপে ভালো আবেদন উপেক্ষার আশঙ্কা থাকে। তাই কিছুটা সময় হাতে নিয়ে আবেদন করতে হবে।